স্ট্রোক (Stroke) একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি যা বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে একটি বড় আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO- World Health Organization) তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১.৫ কোটিরও বেশি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন আর এদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ততক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করেন। (WHO, n.d.) সেই সাথে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ স্থায়ীভাবে অক্ষম (Disabled) হয়ে পড়েন তবে অবশিষ্ট ক্ষেত্রে যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে পুনরায় সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব হয়ে থাকে।
স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য যেমন স্ট্রোকের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি তেমনি ভাবে স্ট্রোকের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে স্ট্রোকের কারণ ও প্রতিরোধের উপায় জানতে হবে। আর তাই এই অনুচ্ছেদে স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় সহ স্ট্রোক সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
স্ট্রোক (stroke) কি?
স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ জনিত একটি জটিল রোগ। শরীরের অন্যান্য কোষের মতোই মস্তিষ্কের কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেওয়ার জন্য মস্তিষ্কে অনবরত রক্ত প্রবাহ চলতে থাকে। কোনো কারণবশত মস্তিষ্কের রক্ত নালীতে রক্ত জমাট বেঁধে অথবা রক্ত নালী ছিঁড়ে যাওয়ার দরুন মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় স্ট্রোক বা Cerebrovascular Accident (CVA) বলা হয়। স্ট্রোক একটি জরুরি অবস্থা যা হঠাৎ করে হয়ে থাকে।
স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের যে অংশটুকুতে রক্ত প্রবাহ বিঘ্নিত হয় সেই অংশের কোষ গুলো সজীবতা হারায় তথা আস্তে আস্তে কোষগুলো মরে যেতে থাকে। এমতাবস্থায় মস্তিষ্কের উক্ত কোষগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শরীরের অঙ্গগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে অক্ষম হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য মানুষের শরীরের সমস্ত অঙ্গ মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে।
অনেকেই হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে ভুল করে থাকেন। মূলত হার্ট অ্যাটাক হলো হৃৎপিণ্ডের (Heart) রক্ত প্রবাহের অস্বাভাবিকতা জনিত রোগ আর স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের অস্বাভাবিকতা। মনে রাখবেন হৃদপিণ্ডে কখনো স্ট্রোক হয় না।
কি কারণে স্ট্রোক হয়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য মতে স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure) এবং ধুমপানের অভ্যাস। (WHO, n.d.) এছাড়াও আরো যে সমস্ত বিষয় গুলোকে স্ট্রোকের কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়ে থাকে তা হলোঃ
- অনিয়ন্ত্রিত ও অলস জীবন যাপন
- অতিরিক্ত লবণ এবং চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ (বিশেষত স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট)
- মদ্যপানের অভ্যাস যা মূলত রক্তচাপ (Blood Pressure) ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়
- মহিলাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি (Oral contraceptive pill) সেবন ইত্যাদি
কোন খাবার গুলোতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
স্ট্রোক এর রিস্ক ফেক্টর গুলো কি কি?
স্ট্রোক এর রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) বা ঝুঁকির কারণ সমূহ নিম্নরূপ:
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা (Obesity)
- ৫৫ বছরের বেশি বয়স
- স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস
- ডায়াবেটিস (Diabetes)
- হার্টের সমস্যা (cardiovascular diseases)
- ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি
নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী মহিলাদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া এবং স্ট্রোকের ফলে মৃত্যুর অনেক বেশি সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। (Holland, 2021)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোতে স্ট্রোকের ঝুঁকি কম রয়েছে। এর কারণ হলো সবার মাঝে স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা এবং সেই সাথে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (WHO, n.d.) পক্ষান্তরে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখনো সাধারণ মানুষদের মধ্যে যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং সেই সাথে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যপারে রয়েছে উদাসীনতা যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
স্ট্রোক কত ধরনের হয়? (Types of Strokes)
মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের অস্বাভাবিকতার ধরন অনুযায়ী স্ট্রোকের মূলত তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে। যেমনঃ
Transient ischemic attack (TIA)
এটিকে মৃদু প্রকৃতির স্ট্রোক (mini stroke) বলা হয়। কারণ এই ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে সাময়িক ভাবে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার দরুন মস্তিষ্কের সামান্য কিছু অংশে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে থাকে। তবে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পুনরায় রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং স্থায়ীভাবে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না।
মৃদু প্রকৃতির এই স্ট্রোকের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা না গেলেও এটিকে অবহেলা করা যাবে না। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে মৃদু প্রকৃতির স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে জটিল প্রকৃতির স্ট্রোকে (Major stroke) আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করা জরুরি। (Wedro, 2021)
Ischemic stroke
এটি জটিল প্রকৃতির স্ট্রোকের মধ্যে অন্যতম যা সবচেয়ে বেশি হারে সংঘটিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যায় অথবা রক্তনালীতে স্থায়ীভাবে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার দরুন মস্তিষ্কের কোষে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে মস্তিষ্কের কোষ সমূহ অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে মারা যায় যার ফলে প্যারালাইসিস বা শারীরিক অক্ষমতা তৈরি হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
Hemorrhagic stroke
এটিও একটি জটিল প্রকৃতির স্ট্রোক তবে তা খুবই কম ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্ত নালী ছিঁড়ে গিয়ে অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহের দরুন মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
উপরে উল্লেখিত তিন ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে একই রকম লক্ষণ দেখা যায় তবে জটিলতার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। অর্থাৎ Ischemic এবং Hemorrhagic stroke এর ক্ষেত্রে পরবর্তীতে জটিলতার সৃষ্টি হলেও Transient ischemic attack ততটা মারাত্বক প্রকৃতির নয়।
স্ট্রোক এর লক্ষণ (Symptoms of stroke)
মানুষের মস্তিষ্কের দুইটি অংশ রয়েছে যার ডান অংশ শরীরের বাম পার্শ্ব এবং বাম অংশ শরীরের ডান পার্শ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের যে অংশের কোষে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে থাকে তার উল্টো দিকের অঙ্গগুলোর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। তবে সার্বিক ভাবে অন্যান্য আরো কিছু লক্ষণাবলী দেখা যেতে পারে। যেমন-
- বমি বমি ভাব অথবা বমি
- খিঁচুনি (seizures)
- হঠাৎ করে তীব্র মাথা ব্যথা
- হাত ও পা অবশ হয়ে যাওয়া
- কথা বলতে সমস্যা (Trouble speaking)
- হঠাৎ করে চোখে ঝাপসা দেখা
- হাঁটতে অসুবিধা (Trouble walking)
- শরীরের ভারসাম্যহীনতা
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি
উপরোক্ত লক্ষণ সমূহের মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ (যেমন: বমি, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি) রয়েছে যা স্ট্রোক ছাড়াও অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে। কিন্তু স্ট্রোকের বেলায় যেহেতু রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে থাকে আর তাই ঠিক কি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে যে স্ট্রোক হয়েছে তা জানা জরুরি।
স্ট্রোক রোগ নির্ণয়
লক্ষণ দেখে স্ট্রোক হয়েছে কিনা তা নির্ণয় পূর্বক জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে একটি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। সহজে মনে রাখার জন্য এটিকে FAST নামে অভিহিত করা হয়েছে যেখানে FAST হলো নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ। (Wedro, 2021)
- F- face dropping বা মুখ বেঁকে যাওয়া
- A- arms weakness বা হাত অবশ হয়ে আসা
- S- Speech difficulty বা কথা জড়িয়ে যাওয়া
- T-Time to call 999 (Emergency Ambulance Service)
উপরোক্ত লক্ষণ তিনটি দেখা দেওয়া মাত্রই রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কারণ স্ট্রোক হওয়ার পর যত দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি তত কমতে থাকবে। এবং সেই সাথে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া হলে রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের জাতীয় জরুরি সেবা নাম্বার হলো ৯৯৯ যেখানে কল করার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা তথা অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance) পাওয়া যায়। চিকিৎসা সেবার বাইরেও জরুরি পুলিশ সেবা ও ফায়ার সার্ভিস ইউনিটের সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে কোনো মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ফ্রিতে ৯৯৯ এ কল করা যায়।
স্ট্রোক কিভাবে ডায়াগনোসিস করা যায়?
লক্ষণ দেখে স্ট্রোক নির্ণয় করা শুধুমাত্র হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এতে কি ধরনের চিকিৎসা কার্যকরী হবে এবং স্ট্রোক পরবর্তীতে কি কি জটিলতা হতে পারে তা জানতে কতিপয় মেডিকেল টেস্ট করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। এই পর্যায়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে স্ট্রোক এর জন্য কি কি টেস্ট করা হয়? স্ট্রোকের ধরন নির্ণয়ের জন্য যে সমস্ত টেস্ট বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
-রক্ত পরীক্ষা (Blood Tests): নমুনা হিসেবে রক্ত সংগ্রহ করার পর ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে সুগারের পরিমাণ, কোলেস্টেরলের মাত্রা, প্লাটিলেট (platelets) নামক রক্ত কণিকার সংখ্যা (যা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে) সহ কোনো ইনফেকশন রয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়।
-সিটি স্ক্যান (CT scan): মস্তিষ্কের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কে কোনো টিউমারের উপস্থিতি অথবা রক্ত জমাট বেঁধেছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।
-এমআরআই (MRI): সিটি স্ক্যান পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের অবস্থা যথাযথ ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না হলে তখন এমআরআই করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। যদিও এটি একটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা পদ্ধতি তবে এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোষের কতটুকু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
-অন্যান্য: ক্ষেত্র বিশেষে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন: Carotid ultrasound, Cerebral angiogram, Echocardiogram ইত্যাদি।
স্ট্রোক এর চিকিৎসা (Treatment of stroke)
স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণত Transient ischemic attack (TIA) এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। তবে রোগী ততক্ষণাৎ সুস্থ না হলে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্তের জমাট ভেঙ্গে পুনরায় রক্ত প্রবাহ চালু করার জন্য কিছু ওষুধ নির্দেশিত হয়ে থাকে। যেমনঃ
- Tissue plasminogen activator (tPA)
- Alteplase IV r-tPA
TIA এর রক্ত জমাট ভাঙ্গার জন্য নির্দেশিত এই ওষুধ গুলো Ischemic stroke এর ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে Ischemic stroke যেহেতু TIA এর তুলনায় অধিক জটিলতর সমস্যা আর তাই এই ক্ষেত্রে আরো কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে থাকে যে বিষয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
Mechanical thrombectomy: এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের কোনো একটি বড় রক্তনালীতে ক্যাথেটার (Catheter) প্রবেশের মাধ্যমে বিশেষ ভাবে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত বাইরে বের করে আনা হয়। স্ট্রোক পরবর্তী ৬ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সফলতা পাওয়া যায়।
Surgery: স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত বের করার জন্য ক্ষেত্রে বিশেষে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
Hemorrhagic stroke এর বেলায় চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। কারণ এই ক্ষেত্রে রক্তনালী ছিঁড়ে যাওয়ার দরুন রক্ত প্রবাহ বেড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর তখন চিকিৎসার মাধ্যমে রক্তনালী মেরামত ও রক্ত প্রবাহ কমানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যেমনঃ
ওষুধ: Hemorrhagic stroke এর বেলায় রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে এবং রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে এমন ওষুধ নির্দেশিত হয়ে থাকে। যেমন:
- Anticonvulsants
- Antihypertensive agents
- Osmotic diuretics
অন্যান্য: ওষুধ ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে রয়েছে শল্যচিকিৎসা (Surgery), Coiling, Clamping সহ নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতি যা একজন নিউরোসার্জন (Neurosurgeon) বা ভাস্কুলার সার্জন (Vascular surgeon) রোগীর অবস্থা অনুযায়ী গ্রহণ করে থাকেন।
উল্লেখ্য স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে হবে। পরবর্তীতে উন্নতর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে রয়েছে “ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল“ যা ঢাকার আগারগাঁও এ অবস্থিত।
স্ট্রোক এর ওষুধ (Medications of stroke)
উপরে উল্লেখিত ওষুধ গুলো ছাড়াও আরো কিছু ওষুধ রয়েছে যা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসার জন্য যেমন নির্দেশিত হয়ে থাকে তেমনি ভাবে স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্যেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। (Holland, 2021) যেমন:
Direct-acting oral anticoagulants (DOACs): Hemorrhagic stroke প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি খুব দ্রুত কার্যকরী একটি ওষুধ যা মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহ কমাতে সহায়তা করে থাকে।
Tissue plasminogen activator (tPA): Transient ischemic attack অথবা Ischemic stroke এর আক্রমণে এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হলে তা রক্ত জমাট ভাঙ্গতে (break up) সহায়তা করে। সরাসরি রক্তনালীতে ইনজেকশনের মাধ্যমে এই ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে এটি দ্রুত কার্যকর হয়ে থাকে।
Anticoagulants: Ischemic stroke অথবা TIA এর ক্ষেত্রে এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হলে তা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। আর তাই এই ওষুধটি স্ট্রোক পরবর্তীতে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর জন্যেও নির্দেশিত হয়ে থাকে।
Antiplatelet drugs: এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ওষুধ হলো aspirin এবং clopidogrel যা চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত সেবন করার মাধ্যমে Ischemic stroke এবং TIA এর ঝুঁকি কমে যায়।
Statins: রক্তের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে কোলেস্টেরলের (LDL- low density lipoprotein) উপস্থিতি রক্তনালীর গাত্রে জমা হয়ে রক্তনালীকে সংকুচিত করে দেয়। যার ফলে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং তা একসময়ে স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। Statins হলো এমন একধরনের ওষুধ যা রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ওষুধ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
- rosuvastatin (Crestor)
- simvastatin (Zocor)
- atorvastatin (Lipitor)
স্ট্রোক এ কি কি জটিলতা হতে পারে?
স্ট্রোকের ফলে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। (Mayoclinic, 2021) যেমন:
প্যারালাইসিস (Paralysis): শরীরের যে কোনো এক পার্শ্ব অথবা উভয় পার্শ্বের প্যারালাইসিস হতে পারে। প্যারালাইসিস মানুষকে অক্ষম এবং অকেজো করে দেয় যা পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
কথা বলতে বা খেতে সমস্যা: মুখের মাংসপেশী নিয়ন্ত্রণকারী মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগী স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারে না। সেই সাথে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়।
স্মৃতি শক্তি কমে যায়: স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কিছুই মনে রাখতে পারে না। এছাড়াও চিন্তা করার সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
আবেগ অথবা বিষন্নতা: অনিয়ন্ত্রিত আবেগ (যেমন: অল্পতেই রেগে যাওয়া অথবা কেঁদে ফেলা ইত্যাদি) এবং বিষন্নতায় (Depression) ভুগতে দেখা যায়।
একবার স্ট্রোক হয়ে গেলে রিকভারী করার উপায় কি?
স্ট্রোকের আক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে উপরে উল্লেখিত জটিলতা সমূহের সৃষ্টি হতে পারে। তবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশন (American stroke association) এর তথ্য মতে ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে পুনরায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা দেখা যায়। আর তাই স্ট্রোক আক্রান্ত হয়েও কিভাবে সুস্থ হওয়া যায় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়াবলী সমূহ নিচে তুলে ধরা হলো:
Physical therapy: শারীরিক অক্ষমতা দূর করতে এটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে একজন physical therapist এর সহায়তায় ক্লিনিকে অথবা বাসায় বসে এই সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে।
Speech therapy: স্ট্রোক পরবর্তীতে কথা বলতে সমস্যা হয় এমন রোগীদের জন্য এই থেরাপি নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে থাকে। এই থেরাপি গ্রহণের ফলে রোগী পুনরায় কথা বলতে সক্ষম হয়। অন্যথায় কথা বলা ব্যতীত যোগাযোগ করার অন্য কোনো উপায় (যেমন: ইশারায় যোগাযোগ) শেখানো হয়ে থাকে।
Cognitive therapy: বিশেষ ধরনের এই থেরাপি গ্রহণের মাধ্যমে স্মৃতি শক্তিকে উজ্জীবিত করা যায় এবং চিন্তা করার সক্ষমতা তৈরি হয়ে থাকে।
Relearning sensory skills: স্ট্রোকের ফলে শরীরের সংবেদনশীলতা কমে যায়। বিশেষত বাহ্যিক তাপ, চাপ ও ব্যথার প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম হয় না। এক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে স্ট্রোক পরবর্তীতে প্যারালাইসিসের চিকিৎসায় গ্রামীণ কিছু কুসংস্কার রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় যে নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি (যেমন: কবিরাজি, ওঝার মন্ত্র পাঠ ইত্যাদি) অবলম্বনের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে উপরন্তু জটিলতা আরো বাড়তে থাকে। আর তাই অবশ্যই এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা যাবে না। বরং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
স্ট্রোক কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
স্ট্রোকের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল হলেও স্ট্রোক পরবর্তীতে সব রোগীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখা যায় না। কারণ স্ট্রোক সম্পূর্ণভাবে নিরাময় যোগ্য কোনো রোগ নয়। আর তাই স্ট্রোক কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সেই বিষয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। (Mayoclinic, 2021)
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ যেমন স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তেমনি ভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট গ্রহণ করা হলে তা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL- low density lipoprotein) মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর তাই স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট বর্জন করতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস: মাংস, চর্বি ও সরল শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে এবং সেই সাথে আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড ইত্যাদি বর্জন করা জরুরি এবং ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
ধুমপান ও মদ্যপান: ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: সুস্থ থাকার জন্য যেমন ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি তেমনি ভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। আর তাই ডায়েট কন্ট্রোল ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তে সুগারের মাত্রা তথা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ব্যায়াম: যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য সপ্তাহে অন্তত ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। অর্থাৎ প্রত্যেক দিন ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় ধরে ব্যায়াম করতে হবে। (Holland, 2021)
ঘুম: সুস্থতার জন্য ঘুম একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করতে এবং সেই সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হবে।
স্ট্রোক একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি তবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্ট্রোকের লক্ষণ দেখতে পাওয়া মাত্রই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে স্ট্রোকের ফলে অকাল মৃত্যু এবং স্ট্রোক পরবর্তী জটিলতা হ্রাস করা সম্ভব হয়। সেই সাথে স্ট্রোক যেনো না হয় সেই জন্য রয়েছে স্ট্রোক প্রতিরোধের কার্যকরী উপায় যা এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে। স্ট্রোকের ঝুঁকি ও স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বব্যাপী ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের সকলেরই স্ট্রোক সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান থাকা এবং সচেতন হওয়া জরুরি।
Holland, K. (2021, November 9). Everything You Need to Know About Stroke. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/stroke#risk-factors
Mayoclinic. (2021, February 9). Stroke. Retrieved from Mayoclinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/stroke/symptoms-causes/syc-20350113
Wedro, B. (2021, December 11). Stroke. Retrieved from medicinenet: https://www.medicinenet.com/stroke_symptoms_and_treatment/article.htm
WHO. (n.d.). Stroke, Cerebrovascular accident. Retrieved from World Health Organization: http://www.emro.who.int/health-topics/stroke-cerebrovascular-accident/index.html
Last Updated on July 25, 2022
Was this article helpful?
YesNo